
জাকাত। ইসলামের এক শাশ্বত বিধান। নিছক ইবাদত ছাড়াও এতে রয়েছে আত্মিক ও সামাজিক উৎকর্ষ। জাকাত মুসলিমদের পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য বৃদ্ধি করে, অনুরূপভাবে ধনী-গরিবের বৈষম্য হ্রাস করে। জাকাত আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তার রক্ষাকবচ। জাকাত বিধানের যথাযথ প্রয়োগ হলে সমাজে সুবিধা বঞ্চিত ও অসহায়-দুস্থ মানুষ যেমন থাকবে না, তেমনি মুষ্টিমেয় কিছু পুঁজিপতির হাতে একতরফা সম্পদের পাহাড় গড়ে উঠারও সুযোগ থাকবে না।
জাকাত সম্পদ বৃদ্ধি করে
সম্পদের যথাযথ জাকাত আদায় করলে একদিকে যেমন মন ও আত্মার পরিশুদ্ধি হয়, তেমনি অনাথ-অসহায়ের প্রতি সহানুভূতির মাধ্যমে সম্পদে পবিত্রতা ও খায়ের-বরকত আসে। আর আল্লাহ তাআলা এর সওয়াব বহু গুণে বৃদ্ধি করতে থাকবেন। কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে- আর তোমরা যে সুদ দাও যাতে তা মানুষের সম্পদে যুক্ত হয়ে বৃদ্ধি পায়, আল্লাহর কাছে তা বৃদ্ধি পায় না। পক্ষান্তরে আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্যে তোমরা যে জাকাত দিয়ে থাক, যারা তা দেয় তারাই নিজের সম্পদ কয়েক গুণ বৃদ্ধি করে নেয়। (সুরা রোম : ৩৯)
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, অর্থ : সদকা দ্বারা সম্পদের হ্রাস ঘটে না। বান্দার ক্ষমার কারণে আল্লাহ তার সম্মানই বাড়িয়ে দেন। আর আ
জাকাত সম্পদের ইনসাফভিত্তিক বণ্টন ব্যবস্থা
ইসলাম যেমন ব্যক্তিকে সম্পদের জাকাত প্রদানের আদেশ দিয়েছে, তেমনি ইসলামী শাসনব্যবস্থায় পরিচালিত রাষ্ট্রকে জাকাত উসুল করা এবং এর সুষম ও ইনসাফভিত্তিক বণ্টনেরও বিধান দিয়েছে। যার দরুন জাকাত আর্থ সামাজিক কল্যাণ ও মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধান করে। জাকাতের মাধ্যমে সম্পদের একটি কল্যাণকর ও ইনসাফভিত্তিক বণ্টনব্যবস্থা অস্তিত্ব লাভ করে, যা একটি সমাজের স্বনির্ভরতা অর্জন, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মৌলিক প্রয়োজনাদি পূরণ ও সমাজের সকল মানুষের সম্মানজনক জীবন যাপনের সুযোগ সৃষ্টির এক কার্যকরী ব্যবস্থা।
হজরত মুআযকে ইয়ামেনে গভর্নর হিসেবে প্রেরণের সময় আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন তাতে ইরশাদ করেছেন- আল্লাহ তাদের উপর জাকাত অপরিহার্যরূপে নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যা তাদের সম্পদশালীদের থেকে গ্রহণ করা হবে এবং দরিদ্রদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। (বুখারি শরিফ: ১৪৯৬)
তবে ব্যক্তির গচ্ছিত সম্পদ, স্বর্ণ-রূপার অলংকার ইত্যাদি, যা মানুষ একান্তই নিজের কাছে রাখে, এগুলোর জাকাতের হিসাব রাষ্ট্র খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করবে না; বরং এগুলোর জাকাত আদায়ের দায়িত্ব শরিয়ত ব্যক্তির দায়িত্বে ছেড়ে দিয়েছে। মুমিন বান্দা ও বান্দিগণ তাদের ঈমানের দাবি থেকে যথাযথ হিসাব করে এসব সম্পদের জাকাত নিজ দায়িত্বে আদায় করবে।
জাকাত দরিদ্র শ্রেণির প্রতি করুণা নয়; বরং তাদের অধিকার
আল্লাহ তাআলা দুনিয়ায় মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তাদের মধ্যে কর্মে কে উত্তম তা পরীক্ষা করেন। কখনো সম্পদ দিয়ে পরীক্ষা করেন আবার কখনো সম্পদ হরণ করে। আর মানুষের মধ্যে সম্পদের তারতম্য থাকা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে সমাজের ভারসাম্য বজায় থাকে। আল্লাহ চাইলে সবাইকে ধনী বা গরিব বানাতে পারতেন। কিন্তু তখন আর ভারসাম্য রক্ষা হত না। ধনী-গরিবের পরীক্ষা হত না। তিনি একদিকে যেমন ধনীকে সম্পদ দিয়েছেন তেমনি তার সম্পদে গরিবের হকও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে- আর তাদের সম্পদে নির্ধারিত হক রয়েছে প্রার্থনাকারীর জন্য এবং বঞ্চিতদের জন্য। (সুরা মাআরিজ: ২৪-২৫)
তাই মুমিন ধনী ব্যক্তির বিশ্বাস হল, সম্পদের প্রকৃত মালিক আল্লাহ তাআলা। তিনি নিজ অনুগ্রহে আমাকে সম্পদশালী করেছেন আবার গরিবের নিকট তার হক পৌঁছে দেওয়ারও প্রতিনিধি বানিয়েছেন। সে আল্লাহর আদেশ পালনের জন্য, তাঁর নৈকট্য ও সন্তুষ্টির আশায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে সম্পদের যথাযথ জাকাত আদায়ে উদ্বুদ্ধ হয়। ফলে সে জাকাত প্রদান করাকে গরিবের প্রতি অনুগ্রহ বা করুণা মনে করে না। সে বরং এই ভেবে আল্লাহর শোকর আদায় করে যে, আল্লাহর আদেশ মোতাবেক নির্ধারিত হকদারকে তার হক পৌঁছে দিতে পেরেছে।
লেখক : আলেমা ও মাদরাসা শিক্ষিকা