
আজ ২২ মার্চ ‘বিশ্ব পানি দিবস’। পানির গুরুত্বকে তুলে ধরতে জাতিসংঘ ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের এই দিন ‘বিশ্ব পানি দিবস’ পালনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। সেই হিসেবে ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বিশ্বের প্রতিটি দেশে পানি দিবস পালিত হয়ে আসছে। পানির কষ্টে সবচেয়ে বেশি ভুগছে উপকূলের মানুষ। সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরগুনাসহ উপকূলের বিভিন্ন অংশের লাখ লাখ পরিবার সুপেয় পানি থেকে বঞ্চিত।
উপকূলের সুপেয় পানির সমস্যা মূলত দুটি কারণে তৈরি হয়েছে। এক. জলবায়ু সমস্যার কারণে সমুদ্রে পানির উচ্চতা বেড়ে উপকূলে লবণ পানির প্রবেশ। দুই. চিংড়ি চাষের কারণে বাঁধ ভেঙে লবণ পানি প্রবেশের পর তা আটকে রাখা। একটা সময় উপকূলের পানির চাহিদা মেটানো হতো পুকুর, দীঘি বা আশপাশের বিভিন্ন জলাধার থেকে। প্রকৃতিবিরুদ্ধ কর্মকাণ্ডের কারণে এসব প্রাকৃতিক জলাশয় ভরাট ও নষ্ট হয়ে গেছে। উপকূলীয় এলাকায় এখন পানির একমাত্র ভরসা ভূগর্ভস্থ পানির উৎস।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, ভূগর্ভেও পানি নেই। অনেক আগেই ভূগর্ভের জমানো পানিতে টান পড়েছে। ব্যবসায়িক উদ্দেশে মাত্রাতিরিক্ত অর্থ খরচ করে গভীর নলকূপ বসিয়ে পানি তোলা হচ্ছে। স্থানীয় পানি ব্যবসায়ীরা এসব পানি বিক্রি করছে। যাদের সামর্থ্য আছে সেসব পরিবার পানি কিনে খাচ্ছে। যেসব পরিবারের পানি কেনার অর্থ নেই তারা সময় খরচ করে এবং পরিশ্রম করে দূর দূরান্ত থেকে পানি সংগ্রহ করছেন। এনজিও ও বেসরকারি সংস্থা থেকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য ড্রাম ও ট্যাংকের ব্যবস্থা করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
উজানে পানি প্রত্যাহারের কারণে মিষ্টি পানির উৎস বন্ধ হয়ে গেছে। পানি প্রত্যাহারে নদ-নদীগুলো পানির অভাবে শুকিয়ে গেছে। উপকূলের শত শত নদী তার প্রাণ হারিয়ে বাঁচার জন্য ধুঁকছে। আগে উপকূলজুড়ে নোনা ও মিষ্টি পানির যে পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় ছিলো সেটাও আর নেই। উপকূলীয় বাঁধ ও মাত্রাতিরিক্ত চিংড়ি চাষের প্রভাবে তা নষ্ট হয়ে গেছে। কর্মসংস্থানের অভাব ও সুপেয় পানির সংকটে অনেক পরিবার এলাকা ছাড়ছে। পুরো বাংলাদেশের জনসংখ্যা যেখানে বাড়ছে।
উপকূলের জনসংখ্যা সে তুলনায় বাড়ছে না। সুপেয় পানির সংকট কবলিত এলাকায় জনবসতি আরো অধিক হারে কমছে। পানি সমস্যায় ভুগতে ভুগতে ভুক্তভোগী পরিবার শহরে পাড়ি জমাচ্ছে। মাইলের পর মাইল হেঁটে এলাকার নারী ও মেয়েদের পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে নারীদের নিরাপত্তা হীনতায় ভুগতে হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে সুপেয় পানির সবচেয়ে বেশি অভাব দেখা দেয়।
এ সময় অনেক পরিবার মাসচুক্তি হিসেবে পানি কিনে পান করেন। গরিব পরিবারের সদস্যরা ক্ষেত্রবিশেষে লবণ পানি পান করতে বাধ্য হন। লবণ পানি পান করার কারণে ডায়রিয়া, কলেরাসহ নানাবিধ চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছে লবণাক্ত পানি পান করার কারণে। লবণ পানি পান করার ফলে উপকূলের নারীদের গর্ভপাত ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ছে। পানির চিন্তায় সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে উপকূলবাসীকে। সুপেয় পানির পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে উপকূলের জীবনে। অনেক পরিবার সুপেয় পানি সমস্যায় মেয়েকে বাল্যবিবাহ দিয়ে দিচ্ছেন। উপকূলের মানুষ বারবার পানির সংকটের সমাধান চেয়েছেন মিছিল, সমাবেশ, মানববন্ধনসহ বিভিন্নভাবে। কিন্তু উপকূলের পানির ন্যায্যতা তারা পাচ্ছেন না কোনোভাবেই।
তথ্য মতে, গ্রীষ্মকালে উপকূলের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ সুপেয় পানি পায় না। পানিই যদি জীবন হয় তাহলে উপকূলের মানুষ সেই জীবনধারণের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সুপেয় পানি কিনে খেতে খেতে উপকূলের মানুষ কতদিন টিকতে পারবে তা সময়ই বলবে। একদিকে ভূগর্ভস্থ পানির সংকট অন্যদিকে ভূউপরিস্থ লবণাক্ত পানি সমস্যায় উপকূলবাসী বিপর্যস্ত। উপকূলের পানি ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন সময়ে নেয়া পদক্ষেপ হয়তো সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে কাজে দিয়েছে কিন্তু পরিকল্পিতভাবে কোনো সমাধান আসেনি। আবার সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন সময়ে নেয়া প্রকল্পে রয়েছে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ। পানিকে এখন বানানো হয়েছে বিলাসী পণ্য। পানির মতো মৌলিক চাহিদাকে এখন বোতলে বোতলে বন্দি করে ব্যবসায়িক পণ্যে রূপ দেয়া হয়েছে। উপকূলের মানুষের সুপেয় পানির সংকট যখন তীব্র হচ্ছে তখন বিলাসী পণ্যের দাম আরো বাড়ছে।
‘বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের’ তথ্য বলছে, বিশ্বের প্রায় ৮০ কোটির মতো মানুষ তাদের বাড়ির আশপাশের নিরাপদ পানি থেকে বঞ্চিত। এ ছাড়া প্রতিবছর অনিরাপদ পানি গ্রহণ ও পয়োনিষ্কাশনের মতো মৌলিক সেবা বঞ্চিত হয়ে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। উপকূলে চিংড়ি চাষ বাড়ছে। পাশাপাশি লবণাক্ততার কারণে বাড়ছে সুপেয় পানির সংকট। চিংড়ি ব্যবসায়ীরা উপকূলের মাটিতে চিংড়ি চাষের বদলে কী ব্যবসা করবেন তারও কোনো সমাধান নেই। উপকূলের দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। লবণাক্ততার বিপদে পড়ে গ্রাম ছেড়ে জীবন ও জীবিকার তাগিদে শহরে পাড়ি জমাচ্ছে মানুষ। সময়ের পরিক্রমায় বাস্তবসম্মত ও পরিকল্পিত সমাধান না মিললে লবণাক্ততা যত বাড়বে, সুপেয় পানির সংকট যতো তীব্র হবে, উপকূল ছাড়া মানুষের সংখ্যা ততো বাড়বে। কতো জলবায়ু সম্মেলন এলো গেলো, কতো জলবায়ু তহবিলের বন্দোবস্ত হলো কিন্তু উপকূলে স্বস্তি ফিরলো না। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ৬ নম্বর অভীষ্ট হলো-‘সকলের জন্য নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশন’। উপকূলের লাখ লাখ মানুষ এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলে লক্ষ্য অর্জন করা কী সম্ভব?
গ্রামভিত্তিক লবণ পানির শোধনাগার বসিয়ে এলাকার সুপেয় পানির সমাধান করা যেতে পারে। এ ছাড়া প্রাকৃতিক জলাধার রক্ষা ও উপকূলের নদ-নদীগুলো দখল-দূষণমুক্ত করার পাশাপাশি উজানের পানির ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হবে। উপকূলের পানির ন্যায়বিচার প্রাপ্তি এখন সময়ের দাবি। মনে রাখতে হবে, সুপেয় পানি প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে না পারলে উপকূল টিকবে না।
লেখক: শিক্ষক