ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ , ৪ বৈশাখ ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

nogod
nogod
bkash
bkash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
nogod
nogod
bkash
bkash

নিত্যপণ্যের অগ্নিমূল্যে ভোক্তা অধিকার উপেক্ষিত 

মতামত

মো. জিল্লুর রহমান

প্রকাশিত: ১৮:৫৭, ১৫ মার্চ ২০২৩

সর্বশেষ

নিত্যপণ্যের অগ্নিমূল্যে ভোক্তা অধিকার উপেক্ষিত 

১৫ মার্চ বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস। ভোক্তাদের অধিকার ও স্বার্থকে সমুন্নত রাখার জন্য অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি নানা আয়োজনের মাধ্যমে পালিত হয়। নিত্যপণ্যের অগ্নিমূল্যে মানুষের জীবন এমনিতেই ওষ্ঠাগত। গত জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি ছিলো ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ। অন্যদিকে ফেব্রুয়ারি মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। মূলত খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় ফেব্রুয়ারিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে।ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। পরিবহন ও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হয়েছে।বাজারে চাল, ডাল, ভোজ্য তেল, রান্নার গ্যাস, মুরগী মাংস, শাকসবজি থেকে শুরু করে এমন কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নেই, যার দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে না। অস্বীকার করার উপায় নেই, আমাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হয়েছে, আয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। 
কিন্তু দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণহীন ও লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি জনজীবনকে সত্যিই অতিষ্ঠ করে তুলছে।বাজারে অগ্নিমূল্যে ভোক্তারা নির্বিকার, বিশেষভাবে নিম্নআয়ের মানুষ যা আয় করছে, তার পুরোটাই জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদির জন্য ব্যয় করার মতো অর্থ তাদের হাতে আর থাকছে না।টিসিবির গাড়ির সামনে ভোক্তাদের দীর্ঘ লাইনই বলে দেয় তারা দ্রব্যমূল্যের কাছে কতটা অসহায়! তারা না পারে বলতে, না পারে সইতে। এখানে ভোক্তা অধিকার তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই নয়!

আয় যে হারে বাড়ছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য।কারণ..একটাই, তা হচ্ছে বাজারের ওপর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।বাজার মনিটরিং, তদারকি এবং সে অনুযায়ী প্রতিকারের ব্যবস্থাও নেই।নিত্যপণ্যের অগ্নিমূল্যে সবচেয়ে বেশি কষ্টকর পরিস্থিতিতে পড়ে নিম্নবিত্ত, অবসরপ্রাপ্ত সৎ সরকারি কর্মচারী, প্রবীণ জনগোষ্ঠী ও নিম্নআয়ের প্রান্তিক মানুষ। সবচেয়ে বেশি অসহায় রয়েছে অধিকাংশ প্রবীণ।তারা না ঘরের মরা, না ঘাটের মরা! যেসব চাকরিজীবী সৎভাবে চাকরিজীবন কাটিয়েছে, তাদের অবস্থা আরও শোচনীয়। কারণ..চাকরি জীবনের তাদের সঞ্চয় পেনশন বা গ্র্যাচুইটির টাকাই একমাত্র সম্বল। জীবনের শেষ সম্বল এ সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে তারা সঞ্চয়পত্র কিনেছে।এ সঞ্চয়পত্রের মুনাফার টাকা দিয়ে তাদের সংসার জীবনযাত্রা সম্পূর্ণভাবে নির্বাহ করতে হয়। যেনো নুন আনতে পানতে ফুরায় অবস্থা কিংবা মরার ওপর খাঁড়ার ঘা!

আসলে সরকার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কাছে সম্পূর্ণ নির্বিকার। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বিভিন্ন অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে বিপাকে ফেলছে। একবার যে পণ্যের দাম বাড়ে, তা আর কমে না। সরকারি বিভিন্ন সংস্থা এ ব্যাপারে কাজ করলেও তা তেমন কার্যকর ভূমিকা না রাখায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসছে না। কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) নামে একটি সংস্থা রয়েছে কিন্তু তাদের কার্যক্রমও তেমন লক্ষ্যণীয় নয়। ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য এটি প্রতিষ্ঠিত হলেও বাস্তবে তারা ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণ কতটুকু করছেন তা সর্বসাধারণের বিচার্য। তাদের কার্যক্রম অনেকটা লোক দেখানো নাটক। এছাড়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে, অনেক রফতানিকারক শাকসবজিসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য অতিরিক্ত লাভের আশায় দেশের চাহিদা না মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করছে এবং সরকারও বিষয়টি তদারকি করছে না।

অর্থনীতিবিদরা মুদ্রাস্ফীতিকে অর্থনীতির সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে গণ্য করেন। কারণ.. মুদ্রাস্ফীতি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, মধ্য ও নিম্নবিত্ত আয়ের মানুষের কষ্ট বাড়িয়ে দেয় এবং ভোক্তাদের জীবনমানকে দুর্বিষহ করে তোলে। মানুষ একসময় হতাশায় নিমজ্জিত হয় এবং সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে যায়। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতির অস্থিরতাকেও ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের মুরগীর মাংস, ভোজ্য তেল, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে, অগ্নিমূল্যের কাছে ভোক্তা অধিকার তুচ্ছ। 

বাজারে শুধু পিঁয়াজই ঝাঁজ ছড়ায় না। সম্প্রতি মুরগীর মাংস, তেল ও গ্যাস উত্তাপ ছড়াচ্ছে। শাকসবজির বাজারেও আগুন। দ্রব্যমূল্যের আগুনে জ্বলছে ভোক্তা সাধারণ, ভোক্তা অধিকার সত্যিই ভুলুন্ঠিত। করোনা মহামারীর পর এমনিতেই সব মানুষের আয় রোজগার কম। অনেকে চাকুরি ও কর্ম হারিয়ে দিশেহারা। নিত্যপণ্যের উর্দ্ধগতিতে সীমিত আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। কৃষকও ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না। এর মধ্যে লাভবান হচ্ছে মধ্যসত্ত্বভোগী ফরিয়া ও সিন্ডিকেট চক্র। তাদের দৌরাত্ম্য এতটাই প্রবল, এদের হাতে জিম্মি খুচরা ব্যবসায়ী ও ভোক্তা সাধারণ। সরকার যতই বলুক তারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, আসলে মনে হয় সিন্ডিকেট চক্র সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করছে। সরকার যা করছে, তা পুরোটাই লোক দেখানো নাটক ছাড়া আর কিছুই নয়। 
আসলে দ্রব্যমূল্যের ওপর সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। কৃষকরা শস্য উৎপাদন করে ন্যায্য মূল্য পায় না, ফলে তারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। সরকার যদি কৃষকদের ন্যায্য মূল্য ও প্রণোদনা দিতো তাহলে দ্রব্যমূল্যের ঝাঁজ এত হতো না

বর্তমানে চাল, তেল, মুরগীর মাংস,শাকসবজি ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েই চলছে।প্রতিটি পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণ হিসাবে ব্যবসায়ীরা এক একটি অজুহাত দাঁড় করান এবং সরকারও তাদের সঙ্গে সমস্বরে সুর মেলায়। অথচ কিছু পণ্য আছে সরবরাহে ঘাটতি না থাকার পরও দাম বেড়ে যায়।তাছাড়া, অতিরিক্ত টাকা দিলে এমন কোন পণ্য নেই, যা বাজারে পাওয়া যায় না অর্থাৎ আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়াচ্ছে একদল দুর্বৃত্ত নামক সিন্ডিকেট। আর এর মাশুল গুনছে সাধারণ মানুষ, ভোক্তারা হারাচ্ছে তাদের ন্যায্য অধিকার।নিত্যদিন তাদের পকেট কাটছে, কিন্তু দেখার কেউ নেই, ভোক্তারা নির্বিকার ও চরম অসহায়।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বৃদ্ধি পেয়েছে উৎপাদন খরচ, পরিবহন-ভাড়া, চিকিৎসা ও শিক্ষা খাতের ব্যয়। সরকারি-বেসরকারি সেবার দামও বেড়েছে। যে হারে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে সে হারে মানুষের আয় বাড়ছে না। নিত্যপণ্যের মূল্যের সঙ্গে জীবনযাত্রার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। একটি পরিবার কীভাবে তাদের দৈনন্দিন জীবনকে নির্বাহ করবে তা নির্ভর করে তাদের আয়, চাহিদা এবং দ্রব্যমূল্যের ওপর। প্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের মূল্য যখন সহনীয় পর্যায়ে এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে, তখন তাদের জীবন কাটে স্বস্তিতে। অন্যদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য যখন সাধারণ মানুষের আর্থিক সংগতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে যায়, তখন দরিদ্র এবং অতিদরিদ্র পরিবারে শুরু হয় অশান্তি। তাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে একদিকে জনজীবনে নেমে আসে কষ্টের কালো ছায়া। অন্যদিকে মুনাফাখোর, কালোবাজারিদের কারণে দেশে বিরাজ করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি, ভোক্তারা থাকে নির্বিকার।
নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে বর্তমানে ন্যায়সঙ্গত মূল্যে কোনো পণ্যই আর পাওয়া যায় না। প্রতিটি পণ্যেই যেনো অধিক মূল্যের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে।অথচ এক বা দুই দশক আগেও এই অবস্থা ছিলো না। মানুষ জীবন কাটাতো সাধ্যের মধ্যে ভালো থেকে।শায়েস্তা খাঁর আমলে টাকায় আট মণ চালের কথা যেনো সময়ের রূপকথা। ব্রিটিশ শাসনামলেও দেশের দ্রব্যমূল্য ছিলো নিয়ন্ত্রিত অবস্থায়। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ বিভাগের পর দেশের অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হলেও দ্রব্যের মূল্য সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে ছিলো।সামাজিক নিরাপত্তার সঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তার সম্পর্ক রয়েছে।ইদানিং শোনা যায়..বেঁচে থাকার তাগিদ থেকেও কেউ কেউ অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে, যা খুবই উদ্বেগজনক। 

নিত্যপণ্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে করতে হলে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।অবৈধভাবে দ্রব্য পাচার ও মজুতদারি রোধ করতে পারলে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে না।বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর সমাজব্যবস্থায় কৃষির উৎপাদন বাড়াতে এবং উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে।এক্ষেত্রে কৃষি জমি থেকে সর্বোত্তম ফসল লাভের জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ, উন্নত বীজ, প্রচুর সার ও সেচ ব্যবস্থার সমন্বয় করতে হবে। কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন বাড়লে দাম এমনিতেই স্থিতিশীল থাকবে। বাজারের ওপর সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের বন্ধ হয়ে যাওয়া কল-কারখানার আধুনিকায়ন ও উৎপাদন শুরুর মাধ্যমে পণ্যের মান ঠিক রাখতে হবে। দেশে লাগামহীন দুর্নীতির অবসান ঘটাতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, দেশের সকল মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজ স্বার্থ ত্যাগ করে দেশের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করতে হবে।

নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির ও কষ্টের সম্মুখীন হয় স্বল্প আয়ের মানুষরা। সুতরাং এদের স্বার্থ রক্ষার জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।বাজারের ওপর সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে।অসাধু ব্যবসায়ী যাতে তার ইচ্ছামতো দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি করতে না পারে..সে জন্য দেশের জনগণকেও সচেষ্ট থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, মুনাফাখোর সমাজের উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায়। তাই অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান সব সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য সাধারণ ও নিম্নআয়ের মানুষের ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য নিত্যপণ্যের অগ্নিমূল্য নিয়ন্ত্রণ করে ভোক্তা অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: ব্যাংকার

জনপ্রিয়